যে গুনে সাহাবীগণ বিশ্বব্যাপী ইসলামকে প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিলেন - আবু সালেহীন।
সাহাবীগণ বিশ্বব্যাপী ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন, সে ক্ষেত্রে পেশাগত অন্যতম দুটি বৈশিষ্ট্যে হলো:
১. মুহাম্মদ (স:) সহ তারা সবাই ছিলেন ব্যবসায়ী। ব্যবসাকে তারা সেবার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এবং ইসলাম গ্রহণের ফলে তাদের পেশাগত বৈশিষ্ট্য আরো সৌন্দর্যমন্ডিত হয়ে পড়তো।
কিন্তু আমাদের দায়ীগণ দ্বীনের কাজ করতে গিয়ে নিজের পেশা পরিত্যাগ করেন। পীর মুরিদী ব্যবসা এর মত ধর্মীয় সেবার কাজকে নিজেদের পেশা বানিয়ে নেন। জনগণের কাছ থেকে টাকা তুলে সেই টাকায় কেনা গাড়িতে গাড়িতে চলাফেরা করেন। অর্থাৎ অন্যান্য ধর্মাশ্রয়ী গোষ্ঠীর মত জনগণের দান-দক্ষিণা এর উপর নিজেদের দাঁড় করিয়ে নেন। যা নবী-রাসূলগণের জীবন চরিত এর ভিন্নরূপ।
রসূল (স:) এবং সাহাবীগণের সুন্নত এই যে, ইসলামী নেতৃবৃন্দের একটা পেশাগত পরিচয় থাকবে। রাসূল সাঃ নিজেও একজন ব্যবসায়ী। তারা ব্যবসাকে ইবাদত মনে করত।
নবী করিম (সা.) বলেন, পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালা এমন কোনো নবী পাঠাননি যিনি বকরি চরাননি। সাহাবিরা (বিস্মিত হয়ে) আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনিও কি (বকরি চরাতেন)? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, হ্যাঁ আমিও কয়েক কিরাতের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের বকরি চরাতাম।’ –সহিহ বোখারি: ১/৩০১
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, হজরত মুসা (আ.) বিয়ের মোহর ও পানাহারের বিনিময়ে আট কিংবা দশ বছর নিজেকে মজুরিতে খাটিয়েছেন। -ইবনে মাজা
অন্য হাদিসে রয়েছে, হজরত দাউদ (আ.) ছিলেন বর্ম প্রস্তুতকারী, হজরত আদম (আ.) ছিলেন কৃষিবিদ, হজরত নূহ (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রী, হজরত ইদরিস (আ.) ছিলেন দর্জি এবং হজরত মুসা (আ.) ছিলেন রাখাল। -ফাতহুল বারি: ৪/৩০৪
নিজের উপার্জনে নিয়োজিত ব্যক্তি আবিদের চেয়ে উত্তম: “হজরত ঈসা (আ.) এক ব্যক্তিকে অসময়ে উপাসনালয়ে দেখে প্রশ্ন করলেন, তুমি এখানে কী করো, সে বললো আল্লাহর ইবাদত করি। হজরত ঈসা (আ.) বললেন, তোমার জীবিকার ব্যবস্থা কে করে? লোকটি বলল, আমার একজন ভাই আছে সে জীবিকার ব্যবস্থা করে। হজরত ঈসা (আ.) তখন বললেন, সে তোমার চেয়ে উত্তম।” -হেদায়াতুল মুরশিদীন।
নবী করিম (সা.) বলেছেন, সত্যাশ্রয়ী, আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে অবস্থান করবে। -ইবনে মাজাহ: ১/১৬৫
অন্য হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, ব্যবসায়ীদের পাপী হিসেবে হাশরে উঠানো হবে। মুত্তাাক, পুণ্যবান ও সৎ ব্যবসায়ী ছাড়া। -তিরমিজি: ১/২৩০
নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, আল্লাহতায়ালা ওই ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যে ক্রয়-বিক্রয়ে উদারতা ও নম্রতা প্রদর্শন করে। -ইবনে মাজাহ
হযরত আবু বক্কর (রা:), ওমর(রা:), আলী (রা:) উসমান (র:) সবারই পেশাগত একটা পরিচয় আছে।
হযরত আবু বক্কর (রা:) কাপড় ব্যবসায়ী।
নবী করিম (সা.) বলেছেন, জীবিকা অন্বেষণ করা (অপরাপর) ফরজ আদায়ের পর আরেকটি ফরজ। -মিশকাত ও বায়হাকি: ২৪২
ক্ষমতায় যাওয়ার পূর্বে অথবা রাষ্ট্রের দায়িত্ব পাওয়ার পূর্বে বায়তুলমাল থেকে কখনোই তাদের নিজস্ব খোরপোষ এর টাকা গ্রহণ করেননি। হযরত আবু বক্কর (রা:) কাপড় ব্যবসায়ী। খলিফা হবার পরেও তিনি নিজ ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছিলেন কিন্তু ওমর (রা:) পরামর্শে রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে রাষ্ট্রের বায়তুল মাল থেকে বেতনের ব্যবস্থা করা হয়।
কিন্তু আমাদের দেশে কি হয়?
এমনিতেই আমাদের জনগণকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন এর বেতন, মাদ্রাসার লিল্লাহ বোর্ডিং, ইয়াতিম খানা পরিচালনায় ধর্মরক্ষার খাতিরে চাঁদা দিতে হয়।
কিন্তু পাশাপাশি ধর্মীয় দলগুলো ও যদি দান সদকার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তাহলে বিষয়টি এমন যে একটি অনুৎপাদনশীল গোষ্ঠী রাষ্ট্রের উপর বোঝা স্বরূপ দাঁড়িয়ে যাবে।
এ কারণেই জনগণের টাকায় পরিচালিত একজন মসজিদের খতিব বা বক্তার কথায় যেমন রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ এর ওপর তেমন তাসির হয়না ঠিক তেমনি জনশক্তির টাকায় পরিচালিত পদ ধারী ব্যক্তির কথায় ও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন সেই মানের হয় না।
আর এটি এজন্য যে, অছাত্রদের(পড়াশোনায় লিপ্ত নয়) দ্বারা যেমন ছাত্ররাজনীতি কল্যাণকর নয় ঠিক তেমনি পেশা পরিচয়বিহীন ( নিজ পেশা পরিত্যাগকারি) বা নিজ পেশায় অদক্ষ ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব দ্বারা কাঙ্খিত ফলাফল অর্জন সম্ভব নয়।
২. আরব সাহাবীগণ শাসনকার্য পরিচালনাকে একটি মহৎ কাজ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপায় মনে করতেন। তাই তারা সব সময় জনগণের সেবার মান কিভাবে বৃদ্ধি করা যায় সেটা নিয়ে চিন্তা মগ্ন থাকতেন।
সৃষ্টির সেবা প্রদানে ব্যর্থ হলে তাদের হৃদয়ে আল্লাহর ভয়ে কাঁপতো। রাজকার্য পরিচালনায় একজন আরেকজনের চাইতে কত উন্নত তার একটা প্রতিযোগিতা তাদের মধ্যে থাকতো। আর তাইতো আরবরা হাজার বছরের উপরে এই বিশ্বকে শাসন করতে পেরেছিল।
কিন্তু এখনকার দায়ীগণ রাজ্যশাসন বা জনসেবা কি সেটা ভুলেই গিয়েছেন।
মাসে একটি গ্রুপ দাওয়াতী কাজ
একটি সাধারণ সভা
একটি সামষ্টিক পাঠ
অথবা জনগণের ভুল-ভ্রান্তির গীবত গেয়ে রাষ্ট্র সংস্কার করে ফেলবেন ভেবে নিচ্ছেন।
এলাকার জনগণের দুর্দশা দেখা তো দূরের কথা, নিজ পরিবারের বা আত্মীয়স্বজনের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্য কোন সময় তাদের হাতে নেই। কারণ তাদের মাথা গুনে দাওয়াত দিতে হবে, সদকা তুলতে হবে আর নেতাকে সন্তুষ্ট করতে হবে।
অথচ তার মূল কাজ ছিল:
✓ ইয়াতিমদের অভিভাবকত্ব এর ব্যবস্থা/দায়িত্ব গ্রহণ করা। (সূরা মাউন)
✓অসহায় দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানো (সূরা নিসা ৭৫)
✓নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা (সূরা নিসা ৪)
✓ঋণগ্রস্তদের সহযোগিতা করা। (বাকারা ১৭৭)
✓ধূমপান ও মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করা।
✓ ক্ষুধার্ত প্রতিবেশীর খাওয়ানোর দায়িত্ব নেয়া।
✓ আর তোমাদের কি হল যে, তেমারা আল্লাহর রাহে লড়াই করছ না দুর্বল সেই পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে, যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদিগকে এই জনপদ থেকে নিষ্কৃতি দান কর; এখানকার অধিবাসীরা যে, অত্যাচারী! আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পক্ষালম্বনকারী নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দাও। (সূরা নিসা:৭৫)
আর তাই দ্বীনের দায়ী হবেন তিনি হবেন জনদরদি, মজলুমের পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, জালিমের ত্রাস…. ইত্যাদি রাজনৈতিক চরিত্রের অধিকারী।
তিনি রাষ্ট্রের বেকারদের জন্য এলাকায় এলাকায় ব্যাপক হারে কর্জে হাসানা ফান্ড, ফ্রি চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র, শিক্ষা সেবা কেন্দ্র, সমাজ কল্যাণ সমিতি, যুব ও ছাত্র কল্যাণ সংস্থা, ইয়াতিম মিসকিন বিধবাদের সহযোগিতার জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন।
বি দ্রঃ আমি কোনো দলের নেতা বা দায়িত্বশীল কিংবা কোন নির্দিষ্ট দলকে উদ্দেশ্য করে কিছু লিখিনি।সাধারণভাবে এদেশের ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো(রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক) এর বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেছি মাত্র।
তাই দয়া করে কেউ নিজ দায়িত্বে বিষয়গুলিকে কোন দল নেতা বা ব্যক্তির দিকে নিয়ে নিবেন না।
লেখকঃ আবু সালেহীন
[লেখক “আবু সালেহীন” এই লেখার সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষন করে। লেখকের অনুমতি ব্যাতীত এই লেখা পরিবর্তন বা অন্যত্র প্রকাশ সমর্থন যোগ্য নয়]