বাংলা কম্পিউটিং বলতে আমরা স্বাভাবিকভাবে বুঝি কম্পিউটারের যাবতীয় কাজ বাংলায় করতে পারা। লেখা - পড়া তো থাকবেই, সেই সাথে ফাইলের নাম, ডাটাবেইজ, অনুসন্ধান জাতীয় জটিল কাজ করতে পারা যাবে অনেক সহজেই। আজ আমরা সেটা করতে পারি পৃথিবীর অন্য সব ভাষার পাশাপাশি। ভারত উপমহাদেশের ভাষাগুলিকে কম্পিউটার বোদ্ধারা নাম দিয়েছেন “জটিল ভাষা” (Complex Language) এবং বাংলা ভাষা সেই গোষ্ঠির একটা সদস্য হওয়ায় কম্পিউটারে এই ভাষা স্থাপন করাতে অনেক কাঠ-খঁড় পুড়তে হয়েছে। কম্পিউটারে যে-কোনো ভাষার বহুমুখী ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট গঠন। যেমন: আপনি যদি QWERTY কি-বোর্ড ব্যবহার করেন (আমরা প্রতিদিনের ব্যবহারে যে ইংরেজী কী-বোর্ড লে-আউট ব্যবহার করি) তাহলে যে কম্পিউটারেই বসেই কাজ করেন না কেনো কী-বোর্ডের মাঝের লাইনের সর্ববামের কী চাপ দিলে a লিখা আসবে। বাংলা লিখার জন্য বাজারে বহুবিধ সফটওয়্যার থাকলেও সেগুলি নির্দিষ্ট কোনো গঠন ব্যবহার করতোনা বা এখনো করেনা। যেমন প্রশিকা/বিজয় দিয়ে লিখা একটি বাংলা ফাইল যদি অন্য একটি কম্পিউটারে নিয়ে খোলেন, যেখানে প্রশিকা/বিজয় বা তাঁদের ফন্ট নেই, তাহলে আপনি আবর্জনা ছাড়া কিছুই দেখতে পাবেন না। প্রচলিত সব সফটওয়্যারেরই একই অবস্থা। কম্পিউটারে ভাষার নির্দিষ্ট কোনো গঠন না থাকার কারনে এমনটি হয়ে থাকে।
বিদেশী অপারেটিং সিস্টেম সফটওয়্যার নির্মাতারা এই জাতীয় টাইপিং সিস্টেমগুলিকে বলে থাকেন চোরাই সিস্টেম (hacked system), কারন ইংরেজী অক্ষরগুলির স্থানে বাংলা লেখা (টাইপ) বসিয়ে দিয়ে বাংলা দেখানো হয়, কিন্তু কম্পিউটার মনে করছে যে আপনি ইংরেজীই লিখে যাচ্ছেন। আপনি যদি একজন কম্পিউটার ব্যবহারকারী হয়ে থাকেন এবং প্রশিকা/বিজয় কোনো অফিস স্যুটে বাংলা লিখে থাকেন, তাহলে দেখবেন যে আপনার লেখার নীচে লাল দাগ দিয়ে কম্পিউটার আপনাকে বলছে যে আপনি ভূল টাইপ করছেন, এবং মাঝে মাঝে আবার আপনার লেখা বানানকে সয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক করে দিতে গিয়ে আপনাকে বিপদে ফেলবে। প্রশিকা/বিজয় ব্যবহারকারীরা এটা অবশ্যই জানেন। এমনটি হবার একমাত্র কারণ যে কম্পিউটার মনে করে যে আপনি ইংরেজী লিখছেন। অবাক লাগলেও সত্য যে এই সফটওয়্যারগুলি এতদিন আমাদের ভাষার মেরুদন্ড হয়েছিলো এবং ভাবতে অবাক লাগে যে আমরা টাকা দিয়ে এই সব আবর্জনা কিনে ব্যবহার করেছি দিনের পর দিন। কম্পিউটারে ভাষার একটি নির্দিষ্ট গঠন থাকার সুবিধাগুলি হলো আপনি যেখান থেকেই এই ভাষা ব্যবহার করেন, আপনি একই জিনিস ব্যবহার করবেন। যেমন আমি যদি ইংরেজীতে একটি ই-মেইল লিখে পাকিস্তানে পাঠাই, প্রাপক সেটা সঠিক ভাবেই দেখতে পাবেন। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা ছিলোনা। মানুষের নির্দিষ্ট একটা গঠন আছে বলেইতো আমরা চোখে দেখলে বুঝতে পারি এটা মানুষ। নির্দিষ্ট গঠনের সুবিধাই হলো এটা। ২০০০ থেকে ২০০১ সালে’র মধ্যে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম (www.unicode.org) এবং ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্টেন্ডার্ডাইজেশন (www.iso.org) এর যৌথ উদ্দ্যোগে ইউনিকোড ৩.০ সংস্করণে প্রথমবারের মতন বাংলা ভাষা যোগ করা হয়। সেইসাথে আমরা কম্পিউটারে ব্যবহারযোগ্য মোটামুটি একটা গঠন পেয়ে যাই। কিন্তু সমস্য হলো যে এটা ব্যবহারযোগ্য হবে কি না। কারন আমাদের বহুল ব্যবহৃত অক্ষর “ৎ” এখানে ছিলোনা এবং ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম আমাদের অনেক বিষয় পরিষ্কার করে বলে দেয়নি, যেমন: দাঁড়ি (।) কিভাবে আসবে। এসব নিয়ে দেশের পত্রপত্রিকায় অনেক কিছু লেখালেখি হলেও কেউ সঠিক পদক্ষেপ গ্রহন করেননি এগুলিকে শুধরাবার। প্রথমবারের মত যখন ইউনিকোডের ঐ গঠন ব্যবহার করার চেষ্টা করা হলো, তখন দেখা গেলো আরও অনেক সমস্যা। যেমন: অ্য, এ্য হচ্ছেনা, ৎ (খন্ড ত) লিখা যাচ্ছেনা ইত্যাদী। ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম আমাদের উক্ত বিষয়ে পরিস্কার কোনো নিতিমালা তৈরী করে দেয়নি সেই সময়ে। অনেকদিন সময় নিয়ে এবং অনেক গবেষনার মাধ্যমে বিষয়গুলির সমাধান করা হয়েছে। এখানে একটি মজার বিষয় হলো যে, আমাদের ভাষার অসফল বিষয়গুলি সমাধানের দায়িত্ব বড় বড় কোম্পানীর (যেমন মাইক্রসফট, এডোবি ইঙ্ক) হাতে থাকলেও বাস্তব সমাধান দিয়েছিলো কিছু অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ইউনিকোড কর্তৃক প্রদত্ত বাংলা ভাষার গঠন ব্যবহার করে প্রথম বাংলা ফন্ট (ফন্ট হলো কম্পিউটারে অক্ষর বা লেখা দেখার বা ছাপার জন্য বিশেষ ধরনের প্রযুক্তি) তৈরী করেন “মুক্ত বাংলা ফন্ট” নামক একটি অলাভজনক দলের সদস্যরা। এরপর সেগুলির লক্ষ্য করে উন্নয়নের কাজ চালান সফটওয়্যার নির্মাতা কোম্পানিগুলো। এর পরে ২০০৪ সালের শেষের দিকে আসে ইউনিকোড গঠন ৪.০, যেখানে অনেক পরিস্কার করে সব নিয়ম কানুন উল্লেখ করে দেয়া ছিলো। পরে গতবছর ইউনিকোড গঠন ৪.১-এ খন্ড-ত সহ যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে দেয়া হয়। কম্পিউটারে বাংলা ভাষার নির্দিষ্ট ব্যবহারিক গঠন তৈরীতে আমাদের তেমন দেশের কোনো দৃষ্টান্ত নেই, এটা অনেক দুঃখজনক হলেও সত্য যে সব সমস্যাই সমাধান করেছেন বিদেশী লোকেরা। কয়েকজনের নাম আমার বলা উচিৎ হবে, তাঁরা হলেন ১: এ্যন্ডি হোয়াইট (যুক্তরাজ্য), ২: পল নেলসন (মাইক্রসফট, যুক্তরাষ্ট্র), ৩: ডঃ রবিন আপটন (আল্ট্রুইস্ট ইন্টারন্যাশনাল, যুক্তরাজ্য), ৪: ডঃ গৌতম সেনগুপ্তা (হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত), ৫: প্রদীপ প্রাপিল (মাইক্রসফট, ভারত), ৬: এরিক মুলার (এডোবি ইঙ্ক, যুক্তরাষ্ট্র)। এই ব্যাক্তিরা আমাদের ভাষাকে কম্পিউটারে প্রনয়ণ করার বিষয়ে মারাত্বক ভূমিকা পালন করেছেন। গত ৩০ জানুয়ারী ২০০৬ ইং তারিখে মাইক্রোসফট তাঁর বহুপ্রচলিত অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ এক্সপি’র বাংলা চেহারা ছেড়েছে। মাইক্রসফট এটা ছেড়েছে আসলে পশ্চিমবঙ্গকে লক্ষ্য করে। কিন্তু এর অনেক আগে আমাদের বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবী দলা “অঙ্কুর” (http://www.ankurbangla.org) লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের চেহারা বাংলায় করেছিলো। অঙ্কুরের এই প্রচেষ্টার দৃষ্টান্ত দেখে মাইক্রোসফটের মতন বড় কোম্পানি কিছুটা হলেও ভয় পেয়েছে এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বাংলা চেহারার উইন্ডোজ ছেড়েছে বাজারে। আমাদের মাতৃভাষায় অপারেটিং সিস্টেম হলে আমরা বিভিন্ন দিক থেকে উপকৃত হবো। যেমন: প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই একটি শিশু কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারবে একজন দক্ষ ব্যবহারকারীর মতন। যে-কেউ যে-কোনো কাজ নিশ্চিন্তে করতে পারবে। কোথাও আটকে গেলে সাহায্যকারী ফাইল ব্যবহার করতে পারবে। আর এর সবকিছুই আজকে সম্ভব। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় আমাদের সফলতা আসতে অনেক দেরী হয়েছে। এই সফলতার পেছনে যারা কাজ করেছে বাড়ীর খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত কাজ করেছেন। তবে আজকে আমরা যা পেয়েছি, পরবর্তি প্রজন্ম আর কাউকেই দোষারোপ করবেনা। আজকে আমি যদি একটা বাংলা ইমেইল লিখি আমার আমেরিকার বন্ধুর কাছে (অবশ্যই ইউনিকোড গঠন ব্যবহার করে), সে সেটা কোনো সমস্যা ছাড়াই পড়তে পারবে। বাংলা এখন মুক্ত, বাংলা এখন সবার জন্য। বাংলাদেশের মানুষ না খেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু কম্পিউটার চালাতে আর কোনো সমস্যা হবেনা আগামী দিনে। আমাদের ভাষা বাংলা, বাংলাই আমাদের অহংকার। আমরা এই ভাষায় কথা বলি এবং মোটামুটি সবখানে ব্যবহার করি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে কম্পিউটারের এই যুগে যেখানে কম্পিউটারে পৃথিবীর সব ভাষার একটা পুরনো অবস্থান আছে, বাংলা ভাষার অবস্থান সেই পর্যায়ে আসতে অনেক বেশী সময় লাগলেও শেষ পর্যন্ত কম্পিউটারে বাংলার একটা অবস্থান আমরা করে নিতে পেরেছি। সেজন্য আজ আমাদের অহংকার আরেক ধাপ বেড়েছে। শরিকুল ইসলাম আজাদ – অমি সহকারী প্রতিষ্ঠাতা – একুশে (http://www.ekushey.org)
Powered by Azrul's Jom Comment |